ধর্ষণ মামলা: ভুক্তভোগীর সুরক্ষায় হাই কোর্টের ১৮ নির্দেশনা

Post Image

ধর্ষণের মামলা হলে সংশ্লিষ্ট যে কোনো থানায় তা নেওয়ার পাশাপাশি ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নমুনা সংগ্রহ করে ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানোসহ ১৮ দফা নির্দেশনা এসেছে হাই কোর্টের এক রায়ে।

যৌন নীপিড়ন বা ধর্ষণের শিকার নারীর বা শিশুর সুরক্ষা, নিরাপত্তা, তদন্ত ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট আইন না হওয়া পর্যন্ত ওই ১৮টি নির্দেশনাকে ‘নীতিমালা’ হিসেবে গণ্য করে তা অনুসরণ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।

মানবাধিকার সংগঠন ব্লাস্টের করা এক রিট মামলার শুনানি করে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি কাজী ইজারুল হক আকন্দের হাই কোর্ট বেঞ্চ ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ওই রায় দেয়। পূর্ণাঙ্গ রায়টি গত এপ্রিলে প্রকাশিত হলে সেখানেই ১৮টি নির্দেশনা আসে।

ব্লাস্টের আইনজীবী শারমিন আক্তার বলেন, “রায়ে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট যে কোনো থানায় ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করতে পরবেন ভুক্তভোগী। মামলা নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো রকম কালবিলম্ব চলবে না।

“ভুক্তভোগীকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দিতে হবে, তার গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে। এছাড়া ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য অভিযোগ দায়েরের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নমুনা সংগ্রহ করার নির্দেশনা রয়েছে ১৮ দফার মধ্যে।”

এ আইনজীবী বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশের পর এক মাস হয়ে গেলেও রায়ের পর্যবেক্ষণ, সুপারিশ, নির্দেশনাগুলো এখন পর্যন্ত প্রচারে আসেনি।

আদালত রায়ে বলেছে, ধর্ষণ, যৌন নীপিড়ন, যে কোনো ধরনের যৌন সন্ত্রাস প্রতিরোধে কেবল পদ্ধতিগত নিয়মিত কার্যক্রম ভুক্তভোগীর জন্য যথেষ্ট নয়। তারপরও সংবিধানের আলোকে আইনি শূন্যতা পূরণের লক্ষ্যে বা প্রয়োজনী আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে রায়ে কিছু মতামত দেওয়া হল।

যা যা আছে নির্দেশনায়

১. ধর্ষণ বা যৌন নীপিড়নের অভিযোগের ক্ষেত্রে বিলম্ব না করে থানার দায়িত্বরত কর্মকর্তাকে (ডিউটি অফিসার) দ্রুত লিখিত অভিযোগ নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট থানার আওতায় ঘটনা সংঘটিত হয়েছে কিনা, তা বিবেচনা করতে গিয়ে কোনো রকম বৈষম্য বা বিলম্ব করা চলবে না।

২. অবিলম্বে এ সংক্রান্ত একটি ওয়েবসাইট খুলতে হবে, যেখানে অভিযোগকারী তার অভিযোগ বা তথ্য অনলাইনে নিবন্ধন করতে পারবেন।

৩. কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া থানার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা অভিযোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে বিলম্ব বা অভিযোগ নিতে অস্বীকৃতি জানাতে পারবেন না।

৪. কনস্টেবলের নিচে নয় এমন একজন নারী পুলিশ প্রত্যেক থানায় ২৪ ঘণ্টা রাখতে হবে। ধর্ষণ, যৌন নীপিড়নের মত অপরাধের তথ্য নেওয়ার কাজটি করবেন একজন নারী পুলিশ কর্মকর্তা। আর তা করতে হবে ভুক্তভোগী, ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্য অথবা ভুক্তভোগীর পছন্দমত কারও উপস্থিতিতে।

৫. সব পর্যায়ের ভুক্তভোগীর পরিচয়ের গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে।

৬. প্রত্যেক থানা নারী সমাজকর্মীদের একটি তালিকা তৈরি করবে; যারা সংশ্লিষ্ট থানাকে সহযোগিতা করবেন।

৭. নিরাপত্তা কর্মকর্তা, সমাজকর্মী, আইনজীবী অথবা ভুক্তভোগীর মনোনীত কারও উপস্থিতিতে ভুক্তভোগীর জবানবন্দি গ্রহণ কতে হবে।

৮. একজন ভুক্তভোগী হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে কী অধিকার আছে সে বিষয়ে ভুক্তভোগীকে সচেতন করতে হবে এবং সে অনুরোধ জানালে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যে কোনো তথ্য তাকে দিতে হবে।

৯. তথ্য পাওয়ার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কর্তব্যরত কর্মকর্তা বিষয়টি ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারকে অবহিত করবেন।

১০. বুঝতে অক্ষম এমন ভুক্তভোগী নারী, শিশু বা তরুণীর ক্ষেত্রে প্রয়োজনে ‘করণিক সেবা’ দিতে হবে।

১১. লিখিত তথ্য গ্রহণের পর বিলম্ব না করে তদন্তকারী কর্মকর্তা থানায় উপস্থিত একজন নারী পুলিশের সঙ্গে ভুক্তভোগীকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য পাঠাবেন।

১২. ভুক্তভোগীকে দ্রুত সারিয়ে তোলার জন্য ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে সার্বক্ষণিক প্রয়োজনীয় সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।  

১৩. ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নমূলক সকল মামলায় বাধ্যতামূলকভাবে রাসায়নিক বা ডিএনএ পরীক্ষা করাতে হবে।

১৪. কথিত অপরাধ সংগঠনের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ডিএনএসহ অন্যান্য পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করে তা ফরেনসিক ল্যাব বা ডিএনএ প্রোফাইলিং সেন্টারে পাঠাতে হবে।

১৫. তথ্য সংগ্রহে বা ভুক্তভোগীর স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তদন্তকারী সংস্থার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে।

১৬. যত দ্রুত সম্ভব তদন্তকাজ শেষ করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে।

১৭. নারী, মেয়ে বা শিশুর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে ১০৯২২ এর মত জরুরি নম্বার বাড়িয়ে গণমাধ্যমে তার সচিত্র প্রচার চালাতে হবে।

১৮. ভুক্তভোগীর নিরাপত্তা, চিকিৎসা ও পরামর্শের জন্য প্রত্যেক মহানগরে একটি করে সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।

হাই কোর্ট বলেছে, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন হওয়ার আগ পর্যন্ত এই নীতিমালা মেনে চলতে হবে।

আদালতের রায়ের সুপারিশ, পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনার আলোকে নীতিমালা তৈরি করতে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ মহাপরিদর্শককে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে রায়ে।

বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে উদ্ধৃত করে রায়ে ঘটনার বর্ণনায় বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের ২১ মে রাতে রাজধানী ঢাকায় গণধর্ষণের শিকার হন এক গারো তরুণী। ওইদিন রাত ৯টার দিকে কাজ শেষে ওই তরুণী কুড়িল থেকে উত্তরার বাসায় যাওয়ার জন্য বাসের জন্য একটি সিএনজি স্টেশনের কাছে অপেক্ষা করছিলেন।

হঠাৎ একটি মাইক্রোবাস তার সামনে এসে থামে। দুই যুবক নেমে এসে অস্ত্র দেখিয়ে মুখ চেপে ধরে তাকে গাড়িতে তুলে নেয়। গাড়িতে তুলেই তার মুখ ও হাত-পা বেঁধে ফেলে দুর্বৃত্তরা। এরপর গাড়িটি বিভিন্ন সড়কে ঘুরতে থাকে। গাড়ির ভেতরে পাঁচজন তাকে ধর্ষণ করে। রাত পৌনে ১১টার দিকে উত্তরার জসীমউদ্দীন সড়কে তাকে নামিয়ে দিয়ে মাইক্রোবাসটি পালিয়ে যায়।

ঘটনার রাতে মামলা করার জন্য মেয়েটিকে নিয়ে থানায় থানায় ঘুরে পুলিশের অসহযোগিতার কারণে ভোগান্তি পোহাতে হয় অভিভাবকদের।

মেয়েটির বড় বোনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তাদের বাসা উত্তরায় হওয়ায় তারা প্রথমে মামলা করার জন্য তুরাগ থানায় যান। কিন্তু অন্য এলাকার ঘটনা বলে পুলিশ রাত ৪টার দিকে তাদের ফিরিয়ে দেয়। এরপর ভোর ৫টার দিকে তারা যান গুলশান থানায়। সেখানেও একই উত্তর মেলে।

শেষে সাড়ে ৬টার দিকে ভাটারা থানায় গেলে বলা হয়, ওসি নেই, অপেক্ষা করতে হবে। পরদিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ওসি আসেন এবং তাদের কথা শুনে সাড়ে ১২টার দিকে মামলা নথিভুক্ত করা হয়। চিকিৎসার জন্য তাকে হাসপাতালে নেয়া হয় আরও একদিন পর।

এ ঘটনায় পাঁচটি মানবাধিকার সংগঠন বাদী হয়ে জনস্বার্থে হাই কোর্টে রিট করে। এর শুনানি নিয়ে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের বেঞ্চ ওই বছরের ২৫ মে রুল জারি করে।

সেই সঙ্গে পুলিশের দায়িত্বে অবহেলা এবং ক্ষতিপূরণ প্রশ্নেও রুল জারি ও নির্দেশনা দেয় আদালত। সেই রুল নিষ্পত্তি করে ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রায় দেয়ে আদালত। সেই রায়ের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি গত এপ্রিলে প্রকাশ হয়।