মার্কিন সংস্থা এফবিআইয়ের আদলে গঠন করা হবে দুদক

Post Image

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)’র অনুসন্ধান ও তদন্ত কাঠামো যুগোপযোগী-দক্ষ করে গড়ে তোলা হবে। এটি মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) ও ভারতের অপরাধ ও দুর্নীতিবিরোধী তদন্ত সংস্থা সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই)’র আদলে গঠন করা হবে।   

এজন্য দেশি-বিদেশি ৩১টি দুর্নীতিবিরোধী সংস্থার সঙ্গে সমঝোতা স্মারকে (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে দুদক। এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রমের গুণগতমান নিশ্চিত হবে। একই সাথে চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযান আরো জোরদার হবে। এমনটাই মনে করছেন দুদক সংশ্লিষ্টরা।

দুদক’র সূত্র মতে, এমওইউ স্বাক্ষরকারী সংস্থার মধ্যে রয়েছে- ভারতের অপরাধ ও দুর্নীতিবিরোধী তদন্ত সংস্থা সিবিআই, রাশিয়ার দি ইনভেস্টিগেটিভ কমিটি অব রাশিয়ান ফেডারেশন (আইসিআরএফ) ও ভুটানের অ্যান্টি করাপশন কমিশন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই’সহ বিদেশি আরো ১৮টি দেশের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

এর মধ্যেই এসব দেশ ও সংস্থার প্রধানের কাছে দুদক থেকে চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি এফবিআইয়ের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দুদকের চেয়ারম্যানসহ তিন নির্বাহী বৈঠকও করেছেন। ওই বৈঠকে প্রাপ্ত মতামতের ভিত্তিতে এফবিআই’র আদলে দুদকের অবকাঠামোসহ অনুসন্ধান ও তদন্তের সার্বিক কাঠামো তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

আরো জানা যায়, দুদকের বিধিমালায় পরিবর্তন এনে নিজ দপ্তরে দুর্নীতির মামলা দায়ের, আসামি গ্রেপ্তার বা রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ ও সন্দেহজনক দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত হাতে রেখে সরাসরি মামলা করার যে কার্যক্রম শুরু হয়েছে- সবই ওই প্রক্রিয়ার অংশ। যেমন- দেশে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর যারা গ্রেপ্তার হচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি অবৈধ সম্পদ ও মানি লন্ডারিংয়ের মামলা করছে দুদক।

এছাড়া দুদকের অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকেও নজর দিয়েছে সংস্থাটি। এর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পাশে গণযোগাযোগ অধিদপ্তর ও বিস্ফোরক অধিদপ্তরের পুরনো সেই সরকারি জমি গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওই জমির ওপর ২০ তলা নিজস্ব ভবন নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে।

দুদককে আরো শক্তিশালী করার লক্ষ্যে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণের অংশ হিসেবেই অবকাঠামো উন্নয়নসহ দুদকের কর্মকর্তাদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষণের দিকে নজর দেয়া হচ্ছে। বিদেশি মানের অনুসন্ধান-তদন্তে পারদর্শী করে তুলতে কর্মকর্তাদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করা হচ্ছে। মহাপরিচালক, পরিচালক, উপ-পরিচালক ও উপসহকারী পরিচালক পদমর্যাদার অন্তত ১৫১ জন কর্মকর্তাকে এই বিশেষ প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়।

তাদের মধ্য থেকে কয়েকজন চৌকস অফিসারের সমন্বয়ে তিনটি বিশেষ সেল গঠন করা হয়েছে। মানি লন্ডারিংসহ বড় বড় দুর্নীতির ঘটনা অনুসন্ধান ও তদন্ত করবে এসব সেল। পাশাপাশি তথ্য-প্রযুক্তি ও বিভিন্ন ধরনের ডিভাইস ব্যবহার করে যেসব দুর্নীতি হয়, সেগুলোর অনুসন্ধানের জন্য গঠন করা হয়েছে আরেকটি বিশেষ সেল। এছাড়া প্রশিক্ষিত কয়েকজন কর্মকর্তাকে দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটে সংযুক্ত করা হয়েছে।

এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘আমরা কমিশনের কার্যক্রমকে উচ্চপর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই। এখন যেভাবে আমরা কাজ করছি তা থেকে ভিন্নতর কিছু করার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্তকাজে বড় ধরনের পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি। দুর্নীতি হচ্ছে দেশের উন্নয়নের অন্তরায়। এই দুর্নীতির আগাছা দূর করতে উচ্চপর্যায় থেকে অভিযান পরিচালনাসহ নানা ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। কমিশনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মকভাবে দুর্নীতিবাজদের অবৈধ সম্পদসহ ক্ষমতার অপব্যবহার ও মানি লন্ডারিংয়ের অনুসন্ধান-তদন্ত পরিচালনা করা হচ্ছে। এটি আরো জোরদার হবে।’

দুদক চেয়ারম্যান আরো বলেন, ‘কমিশনের কাজ হবে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে। এমনভাবে অনুসন্ধান ও তদন্তকাজ পরিচালনা করা হবে, যাতে যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হবে তাদের যেন শতভাগ সাজা নিশ্চিত হয়। অপরাধীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও তদন্তে গুণগত মান আরো বাড়াতে কমিশনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুর্নীতির তথ্য আদান-প্রদানে অনেকগুলো দেশি-বিদেশি সংস্থার সঙ্গে কমিশনের চুক্তি হচ্ছে। আশা করি, আটঘাট বেঁধে দুর্নীতি দমন ও রোধ করা গেলে দেশের মানুষ এর সুফল পাবেন।’

দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান জানান, দুর্নীতিবিরোধী অভিযান ঢাকার বাইরেও হবে। প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় তালিকা করে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও তদন্ত পরিচালনা করা হবে। অভিযানকে জোরদার করতে কমিশন থেকে অনেকগুলো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিদেশি সংস্থার মধ্যে এফবিআই ও সিবিআই ছাড়াও কানাডার দ্য রয়েল ক্যানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ (আরসিএমপি), সিঙ্গাপুরের দ্য করাপ্ট প্র্যাকটিসেস ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো (সিপিআইবি), ইন্দোনেশিয়ার দ্য করাপশন অ্যারাডিকেশন কমিশন (কেপিকে), কোরিয়ার অ্যান্টি করাপশন অ্যান্ড সিভিল রাইটস কমিশন (এসিআরসি), চীনার দ্য ন্যাশনাল ব্যুরো অব করাপশন প্রিভেনশন অব চায়না (এনবিসিপি), হংকংয়ের ইনডিপেনডেন্ট কমিশন অ্যাগেইনস্ট করাপশন (আইসিএসি), মালয়েশিয়ার দ্য মালয়েশিয়ান অ্যান্টি করাপশন কমিশন (এমএসিসি), থাইল্যান্ডের ন্যাশনাল অ্যান্টি করাপশন কমিশন (এনএসিসি), ভিয়েতনামের সেন্ট্রাল স্টিয়ারিং কমিটি অন অ্যান্টি করাপশন (সিএসসিএ)।

এছাড়াও কম্বোডিয়ার দ্য অ্যান্টি করাপশন ইউনিট (এসিইউ), ব্রুনাইয়ের অ্যান্টি করাপশন ব্যুরো (এসিবি), ফিলিপাইনের অফিস অব দ্য অম্বাডসম্যান, লওসের পিডিআর, সেনেগালের দ্য ন্যাশনাল অফিস অ্যাগেইনস্ট ফ্রড অ্যান্ড করাপশন (এনওএএফএসি), মঙ্গোলিয়ার দি ইনডিপেনডেন্ট অথরিটি অ্যাগেইনস্ট করাপশন (আইএসিসি) ও শ্রীলংকার দ্য কমিশন টু ইনভেস্টিগেট অ্যালিগেশনস অব ব্রাইবারি অব করাপশন (সিআইএবিওসি) এবং ভুটানের অ্যান্টি করাপশন অব ব্যুরো (এসিবি)’সহ ১৮টি দেশের রাষ্ট্রীয় ঘুষ-দুর্নীতিবিরোধী সংস্থার সঙ্গে চুক্তির বিষয়টি প্রাধান্য দিয়েছে দুদক। এর মধ্যে চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি ভারতের সিবিআই ও রাশিয়ার আইসিআরএসের সঙ্গে এবং ১৪ মে ভুটানের এসিসিবির সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে দুদক।

এদিকে দুদদ’র অনুসন্ধান ও তদন্তকাজ সহজ করতে রাষ্ট্রীয় ১০টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তির বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো হল- বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন, পাসপোর্ট অধিদফতর, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন- র‌্যাব, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউ, এনবিআরের সিআইসি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, বাংলাদেশ পুলিশ, সিভিল এভিয়েশন, তথ্য কমিশন ও টিআইবি।

খবর যুগান্তর।